Featured Post

অপ্সরীর প্রেমে -কবিতা

''অপ্সরীর প্রেমে"    তারেক মাহমুদ সুজন হতবম্ভে মারে মোরে দেখে তোর কোমালতা অদৃশ্যেও খুঁজে পাই নি কবু এমন দারুণ মায়া। স...

Tuesday, June 20, 2017

"দুশ্চরিত্রতার গ্রাসে সন্তান " গল্পঃ তারেক মাহমুদ সুজন


সেই নয় বছর বয়সে ইরিকাকে লন্ডনে নিয়ে যায় তার ফুপি। ইরিকা তখন ক্লাস টুয়ে পড়তো । আজ সে অনেক বড় হয়ে গেছে, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কিশোরী থেকে যুবতীর দলে নাম বসিয়েছে। ফুপির মায়া আর যত্নের কবলে থাকাতে মা বাবাকে ছেড়ে খুব একটা কষ্টে থাকতে হয়নি তাকে। তবে মা বাবাকে খুব একটা যে মিস করতো না তা কিন্তু না। দূরে থাকাতে মা বাবার প্রতি অনেক গভীর মায়া জন্মে গেছিলো ইরিকার । তাই একটু সময় পেলেই পাপা মাম্মি করতে থাকতো, কল দিয়ে মা বাবার সাথে ঘণ্টা অন্তর ঘণ্টা   কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। অনেক অনুভব করতো মা বাবার দূরত্বকে। আর তাই উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেই ফুপিকে বুঝিয়ে মা বাবার সাথে দেখা করতে দেশে চলে এসেছে ইরিকা। মনে মনে চিন্তা করতেছে মা বাবাকে ছেড়ে আর যাবেই না মা-বাবাহীন ভিন্দেশে।তাই শহরের নামকরা প্রথম সারির একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যায় ইরিকা।  ইরিকা তার মা বাবার এখন পর্যন্ত একমাত্র সন্তান। বয়সটা সবে মাত্রে আঠারো পার হয়ে উনিশে এসে পথ শুরু করেছে। আর দেখতে একদম পুতুলের মত লাগে ইরিকাকে, বাচ্চা স্বভাবের মেয়েটি যেমন সুন্দর তেমন কোমল অনুভূতি সম্পন্না । তার মা বাবার বয়সও তেমন একটা হয়নি। তাদেরকে দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না তারা যে এত বড় এক কণ্যা সন্তানের জনক জননী। বাবাকে দেখতে একটু বয়স্ক মনে হলেও নিজ মাকে দেখতে মনে হয় পাঁচ-ছয় বছরের বড় নিজ বোনের মত। তাই দেশে এসে মায়ের সাথে তার বন্ধুর মতই সখ্যতা তৈরী হয়ে গেছে। ইরিকা তার জীবনে যত ঘটনা অঘটা আছে সব কিছুই মায়ের সাথে বন্ধুর মত  ভাগাভাগি করতে ভালোবাসে। মাও মেয়েকে বন্ধু হিসেবো মেনে নিছে, মা-মেয়ে আড্ডা তামশায় খুব ভালোই সময় কাটাচ্ছে ইরিকা। এক্ষেত্রে বাবাও পিছিয়ে নেই, মেয়েকে অনেক আদর করে। রাতে এসে মেয়েকে ঘুম থেকে উঠিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। ইরিকাও বাবার হাতে খাওয়া ছাড়া খায় না। একদম নাছরবান্দা,  মায়ে অনেক বকে এত বাপ আদুরী মেয়ে হওয়ায়। এভাবেই দেশে এসে মা বাবার আদর, যত্ন, ভালেবাসা দেখে বিষণভাবে মুগ্ধিত কমলমতি ইরিকা। মা বাবার প্রতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাগ অভিমানে খুবই ভালো সময় পার করছে সে। ভিতরের কোমলতা আর বাচ্চামিটাও চলছে সমান গতিতে।  প্রায়ই ভাবে এমন সুখের স্বর্গ ছেড়ে শুধু শুধু জীবনের দশটি বছর কাটিয়েছি বিদেশে। কিন্তু সেই কোমল নিষ্পাপ মনের মেয়েটির সুখ-আহ্লাদ তার নিজ মা বাবার কাছেই সহ্য হয়ে উঠেনি। ধীরে ধীরে তারাই নিজ জন্ম দেয়া পুতুলের ন্যায় মেয়েটির সুখের পথে বাধা হতে তিল পরিমাণ কুণ্ঠাবোধ করেনি।

ইরিকা আজ তার বন্ধুদের সাথে রাতে একটা পার্টিতে যাবে বলে সকাল থেকেই আহ্লাদিত।  বাবাকে না পেয়ে মাকে বলে চলে যায় বন্ধুদের সাথে। শহরের নামকরা কোন নাইট ক্লাবে এটাই ইরিকার প্রথম আসা । ক্লাবটি তিনটি ভাগে বিভক্ত, নিচ তলাটি কম বয়সী তরুণ-তরুণীদের জন্য, বসার টেবিল  আর গান- নাচার মঞ্চ দিয়ে সজ্জিত। তার উপরের তলাটি মধ্যবয়সী বা বিবাহিতদের জন্যে সংরক্ষিত যারা এখানে কিছু মদ্য জাতীয় পানি প্রাণ করে মাতাল অবস্থায় গান নাচ করে থাকে।  আর তারও উপরের তলাটি কারো রাত কাটানোর সুব্যবস্থায় অতি সুন্দর করে তৈরী খোপ খোপ রুম। কৌতূহলপ্রিয় কিছু বন্ধুরা ইরিকাকে নিয়ে নিচ তলা থেকে উপরের ধাপ গুলো দেখতে যায়। দ্বিতীয় তলায় গেলে একপর্যায়ে নাদিয়া ইরিকাকে বলে কিরে ইরিকা, তোর বাবা-মা এখানে!  বললি না তো ওনারাও যে আসছে! ইরিকা বিস্মিত হয়ে বলে উঠলো আমার বাবা-মা?
কোথায় দেখলি তুই?  তার পর নাদিয়া আঙ্গুল দিয়ে একটু দূরে দেখিয়ে বলে উনি তোর আব্বু নয়?  ভার্সিটিতে প্রায়ই তো দেখি উনি তোকে গাড়িতে করে আসা নেওয়া করে। ইরিকা প্রথমে দেখে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। পরে দেখে তারই বাবা নিজ বয়সী অন্য মেয়ের সাথে মৃদু মাতাল অবস্থায় নাচ্চে।  বন্ধুরা সবাই বলে কিরে তোর মা বাবাও আসছে, বললি না কেন?  ইরিকা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো শুধু আমার বাবা এসেছে, মা নয়। মহিলাটাকে আমিও চিনি না,  সবাই অভাক আর হতবম্ভিত হয়ে পড়ল আর কেমন যেন ঘৃণিত চোখে ইরিকার দিকে তাকিয়ে এটা সেটা জিঙ্গেস করতে শুরু করলো।

বন্ধুদের আর কোন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দুনিয়ার সকল লজ্জার ভার কাধে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে এলো ইরিকা। এসে চিৎকার করে আম্মি আম্মি করতে লাগলো কিন্তু আম্মিও বাসায় নেই। বাড়ির কাজের মহিলাটা এসে জানায় ইরিকা তুমি যখন ঘুমিয়ে পড়ো তোমার মা প্রতিদিনই তখন বাহিরে চলে যায়। আজও গেছে এখনও আসেনি। ইরিকা প্রথম বুঝতেই পারেনি তার স্বর্গতুল্য মা কোথায় গেছে। বিষণ্ন মনে ইরিকা বাসার ছাদে বসে আছে আর নিজ বাবার কৃত নির্লজ্জতার দৃশ্য তার চোখে ভেসে বেড়াচ্ছে।

রাত প্রায় তিতটা চল্লিশ মিনিট একটু পরই ফজরের আজান কানে পৌঁছবে এমন সময় ছাদ থেকে দেখে বাড়ির সামনে একটা গাড়ি দাঁড়ালো। ইরিকা ভাবছে হয়ত তার কলঙ্কচিহ্নিত বাবা এসেছে। কিন্তু পরে তাকিয়ে দেখে একটা মধ্যবয়সী অচেনা পুরুষ তার মাতাল মাকে তার নিজ কাধে হাত তুলে ধরে ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিলো। নিজ চোখে পৃথিবীর সব চেয়ে পবিত্র ভাবা নিজ মা বাবার এমন চরিত্রহীন নষ্টামি দেখে ইরিকার চোখ দিয়ে নির্বাক আশ্রুর স্রোত অজোরে ঝরে পড়তে লাগলো। শান্ত আকাশটা আজ এতই বিষক্ত হয়ে উঠেছে যে তার বিন্দু মাত্র নিশ্বাস নিতে মন চাচ্ছে না ইরিকার। একটা সন্তানের কাছে পৃথিবীর সব চেয়ে ঘৃণিত মুহূর্ত হলো তার নিজ জন্ম দেয়া মা বাবার দুশ্চরিত্রের দৃশ্য নিজ চোখে দেখা।

ইরিকা কি করবে বুঝতে পারছে না অনেক ভাবার পর ফুপির কথা মনে পড়লো, ফুপিকে কল দিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো ইরিকা। ফুপি কিছুতেই তার কাঁদা থামাতে পারছে না, মনে হচ্ছে হৃদয় ভেঙে কাঁদার শব্দ বের হচ্ছে। নিশ্চুপ আকাশটাও আরো চুপ হয়ে গেছে। মৃদু এই স্নিগ্ধ বাতাসের প্রতিটা কণা যেন এই পুতুল ন্যায় নিষ্পাপ মেয়ের বুক ফাটা আর্তনাদের সাক্ষী হয়ে স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। তারপর আর্দ্র কণ্ঠে ফুপিকে সব খুলে বললে ফুপি বলে, দশ বছর আগেও তোর মা বাবা এমনই ছিলো,তোকে অনাদর অবেহেলায় রেখে তারা এখানে সেখানে চলে যেত। প্রায়ই তোকে নিয়ে তাদের মধ্যে তুমুল বিভেদ বাঁধতো । এইজন বলতো তোমার মেয়ে তুমি সামলাও সেইজন বলতো না, তোমার মেয়ে তুমি সামলাবা।  নিজ মেয়ের প্রতি এমন নিঃস্পৃহ পশুসুলভ আচরণ দেখে আমি সহ্য করতে না পেরে তোকে নিয়ে এসেছি।
নিজ মেয়ে সন্তান নেই বলে নিজ মেয়ের মতোই তোকে আদর যত্নে বড় করেছি, কখনও মা বাবার অভাব বুঝতে দেই নাই। ভেবেছি সারা জীবন আমার কাছেই রেখে দিবো কিন্তু তুই নিজের নাড়ির টানটাকেই বড় করে দেখে চলে গিয়েছিলি। ফুপি বলে, জানিছ তুই একদির তোর মাকে কল দিয়ে কত আদরমিশ্রিত লজ্জা ভাব নিয়ে বাচ্চা মেয়ের মত বলতে লাগলি, আম্মি আমার একটা ছোট্ট ভাই বা বোন লাগবে, যেন দেশে এসে সারাদিন তার সাথে দুষ্টামি করতে পারি। কথাটা শুনে আমার চোখের কোণে অশ্রু জমে গিয়েছিলো সেদিন,যে মা বাবা তার একমাত্র সন্তাকেই এভাবে দূরে রেখে নিজ নিজ উল্লাসে জীবন কাটাচ্ছে সে মা বাবার বিবেকে মেয়ের এমন মায়াময়ী আবদার ঠেকার ন্যূনতম স্থান হয় না চিন্তা করে।

ফুপির কথা শুনে ইরিকার আকাশটা আরো বিষাদে চেয়ে গেলো। সকাল হয়ে গেলো, ইরিকা সারা রাত নির্ঘুমা চোখে একটু পানির ছিটা দিয়ে একটা চিঠি লেখতে বসলো।

চিঠিটা ছিলো,

"হয়ত আমাকে জন্ম দেয়ার কোন ইচ্ছাই তোমাদের ছিলো না, হয়ত তোমাদের একটু ভুলের কারনেই ভুলের ফসল হয়ে এই পৃথিবীতে আমার আসা। তবে জানো, সৃষ্টিকর্তা যদি আমাকে তিলার্ধ ক্ষমতা দিতো আমি কোন দিনমজুরের মেয়ে হয়ে এই সুন্দর পৃথিবীতে আসতে চাইতাম,তোমাদের অপবিত্রতার সাক্ষী হয়ে সমাজে কলঙ্কের মুখ দেখাতে আসতাম না।
তোমাদের এই ঐশ্বর্য, ধন-সম্পদ, গাড়ি বাড়ির দেয়ালে যে নির্মম,দুশ্চরিত্রের চিত্র ভেসে উঠে তা আমাকে তোমাদেরকে মা বাবা হিসেবে মানতে আকাশচুম্বী লজ্জা দেয়। দুঃখিত, তোমাদের এই পাপময় অসামাজিক দুশ্চরিত্রের জগতে মেয়ে হয়ে আর থাকতে ইচ্ছা নেই বলে। চলে গেলাম বাবা, চলে গেলাম মা। হয়ত পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে ক্লান্তির শেষ ঘুমটি ঘুমাচ্ছো আর তাই আমার শেষ যাওয়াতেও বাধা দিতে পারবে না।"
লিখার সময় পুরো চিঠিটাতেই  ইরিকার চোখের পানি ঝরে ঝরে শুষ্ক কাগজ ভিজে কোমল আর্দ্র হয়ে গেলো।

অতঃপর চিঠিটা নিজ টেবিলে রেখে তার সাথে বাবার দেয়া দামি মোবাইলটি ও মায়ের দেয়া সকল স্বর্ণ অলংকার রেখে সজল চোখ আর লজ্জাভরা দেহ মন নিয়ে শেষ বারের মত বাসা থেকে বের হয়ে গেলো পুতুল মেয়ে ইরিকা।  (সমাপ্ত)